আমাদের কথা:
১৯৯৬ সালের জুন। পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেই এক সপ্তাহের ভেতর চাকরী নিয়ে নিলাম অটো ইকুইপমেন্ট লি: (পরবর্তীতে আবেদীন ইকুইপমেন্ট লি:) এ। সম্পূর্ন নতুন, কোন ধারনা নেই এরকম প্রডাক্ট নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রডাক্টটি হচ্ছে পাওয়ার টুলস, জার্মানির ব্র্যান্ড Bosch। পাওয়ার টুলস তখন শুধুমাত্র নবাবপুরে বিক্রি হওয়া পন্য। আর Bosch ব্র্যান্ড একদমই নতুন, কেউ নামও জানে না। অথচ সারা পৃথিবীতে তারা হচ্ছে মার্কেট লিডার। আদা জল খেয়ে নেমে পরলাম। শুরু হলো নবাবপুরের বাইরে পাওয়ার টুলস মার্কেটিংয়ের এক আলাদা জগত। পাওয়ার টুলস বলতে তখন প্রচলিত ছিল মূলত ড্রিল ও গ্রাইন্ডিং মেশিন। কাঠে কাজ করার জন্য কোন পাওয়ার টুলস এর ব্যবহার প্রচলিত ছিল না। এমনকি হাতিল, আখতারের মত ফ্যাক্টরীতেও হাতে গোনা ২-৩ টা টুলস ব্যবহার হত। আমরাই প্রথম কাঠে কাজ করার জন্য প্লেনার, সারকুলার স, জিগ স, রাউটার, সেন্ডার এই মেশিনগুলো আনলাম। সেই সময় সারা বাংলাদেশে শত শত ফার্নিচার কারখানায় এই মেশিনগুলো নিয়ে গিয়েছি, হাতে কলমে কাজ করে দেখিয়েছি। ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ফার্নিচার শিল্পে পাওয়ার টুলসের ব্যবহার শুরু হলো।
১৯৯৯ সালে ক্যাটালিস্ট নামে সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক একটি এনজিও বাংলাদেশের ফার্নিচার শিল্প উন্নয়নের একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করলো। প্রকল্পের অর্থের যোগানদাতা ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ফার্নিচার শিল্পের সাথে টেকনোলজী নিয়ে প্রফেশনালি কাজ করা একমাত্র প্রতিষ্ঠান তখন Bosch পাওয়ার টুলস। তাই তারা আমাকে আমন্ত্রন জানালো তাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল টেকনোলোজীর ব্যবহার, শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি, কারখানার পরিবেশ ও শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কিভাবে এই শিল্পের উন্নতি করা য়ায়। ক্যাটালিস্টের সাথে প্রায় দশ বছর এই বিষয় নিয়ে কাজ করেছি যতদিন তারা এই প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছে। সারা বাংলাদেশ ঘুরে শত শত ফার্নিচার কারখানায় প্রোডাকশন নিয়ে ট্রেনিং করিয়েছি। ছোট ছোট পাওয়ার টুলস দিয়ে কিভাবে কাজ করে তা শিখাতাম। বড় মেশিন নিয়ে তখন কেউ চিন্তাই করতো না। ফ্যাক্টরীগুলোর সাথে কাজ করতে করতেই ফার্নিচারের সাথে আমার আলাদা একটা সঙ্গ তৈরী হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে ফার্নিচার প্রোডাকশন নিয়ে ব্যাপক পড়াশুনা শুরু করি। ইউরোপ ও তাইওয়ানের বিভিন্ন মেশিনারীজ কম্পানির ক্যাটালগ নিয়ে আসতাম ও সেগুলো স্টাডি করতাম। তবে সেই সময়ের অটবির কথা না বললেই নয়। অটবি তখন একটি স্বকীয় ফার্নিচার কম্পানি হিসেবে দাড়িয়ে গেছে। একমাত্র অটবিতেই তখন আধুনিক মেশিনারীজ ব্যবহার হয়। কিন্তু সেটা তখন বাইরের কারও জানার বা দেখার সুযোগ ছিল না।
ইসলাম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আফতাব অটোমোবাইলস সাভারের ফুলবাড়িয়ায় হিনো গাড়ীর বডি বিল্ডিং করে।তারা Bosch এর বিভিন্ন টুলস ব্যবহার করে। গ্রাইন্ডার, ড্রিল, রেন্চ ইত্যাদি এবং সাথে কাঠের কাজের জন্য জিগ স, সারকুলার স মেশিন। তারা আমার ঘনিষ্ঠ কাষ্টমার। আমি মাঝে মাঝেই সেখানে যাই।১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি। আফতাব অটোমোবাইলস থেকে একদিন সকাল বেলায় মেকানিকাল ইন্জিনিয়ার হেলাল ভাইয়ের ফোন। দেখা করতে হবে। সাথে সাথে রওনা হয়ে ফুলবাড়িয়া গেলাম। মিটিং এর বিষয় ফার্নিচার ফ্যাক্টরী। আফতাব অটোমোবাইলস ফার্নিচার ফ্যাক্টরী করতে চায়, আমি এই বিষয়ে কোন সহায়তা করতে পারবো কিনা, ফার্নিচার তৈরীর ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিন সম্পর্কে আমার কোন ধারনা আছে কিনা। সৌভাগ্যবশত সেই সময়ে আমার বেশ কিছু ধারনা তৈরী হয়েছে। আমি দায়িত্ব নিলাম। প্রোডাকশন টার্গেট হচ্ছে অটবির মত অফিস ফার্নিচার। মাস দুয়েক খেটে খুটে মেশিনের লিস্ট দাঁড় করালাম, একটি সম্ভাব্য প্রোডাকশন লেআউট প্ল্যানও তৈরী করলাম। বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার এক সাপ্লাইয়ারের কাছে সব মেশিন পাওয়ার সম্ভাব্যতা পাওয়া গেল। তখন পৃথিবীতে ফার্নিচার প্রোডাকশনে মালয়েশিয়ার রাজত্ব। তাই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সেখান থেকে সংগ্রহ সুবিধাজনক। সব মেশিনের টেকনিকাল ডিটেইলস পর্যালোচোনা করে ফাইনাল লিস্ট তৈরী করলাম। অটো এজ বেন্ডার মেশিন জার্মানির, স্লাইডিং স ইতালীর আর বাকী সব মেশিন ছিল তাইওয়ানের। অটোমেটিক টুলস চেন্জার সহ সিএনসি রাউটার মেশিনটির দাম ছিল সত্তর লাখ টাকার উপরে।
২০০০ সালে অটবির পর আধুনিক মেশিনারীজ নিয়ে বাংলাদেশের ২য় ফার্নিচার ফ্যাক্টরীর যাত্রা শুরু হল। পরবর্তীতে সবাই তাকে চিনে নাভানা ফার্নিচার নামে। আমার সৌভাগ্য অটবির পর বাংলাদেশে আধুনিক ভাবে ফার্নিচার তৈরী শুরু হয় আমার হাত ধরে। আর ফার্নিচার শিল্পে বাংলাদেশের প্রথম সিএনসি রাউটার মেশিনটিরও যাত্রা শুরু হয় আমার হাত ধরে। মজার ব্যাপার হল তখন মেশিনটি চলত DOS (ডজ) সিস্টেমে। মেশিনটি এখনও চলছে।
চলবে……..